ইন্টারনেট স্পীডে সমস্যা: কখন আপনার ISP দায়ী নয়?

আপনি হয়তো নতুন একটি রাউটার কিনে আনলেন, যার স্পেসিফিকেশনে লেখা রয়েছে গিগাবিট স্পিড, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, শক্তিশালী CPU, কিন্তু ব্যবহার করতে গিয়ে দেখছেন—পিং টেস্টে বারবার ল্যাটেন্সি (latency) ১০০০ms এর ওপরে চলে যাচ্ছে! LAN দিয়ে সরাসরি সংযোগ দিলে 1ms, অথচ Wi-Fi ব্যবহার করলেই অসহনীয় ল্যাটেন্সি। আপনি ভাবলেন, অবশ্যই ISP বা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের সমস্যা।

কিন্তু আসলেই কি তাই?

আজকের পোস্টে আমরা Wi-Fi পিং ল্যাটেন্সি সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, এবং ব্যাখ্যা করব এই সমস্যার আসল কারণ ও সমাধানের সম্ভাব্য পথ।

ইন্টারনেট সংযোগ বনাম আপনার লোকাল নেটওয়ার্ক

প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে যে ISP আপনাকে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করে, যা সাধারণত আপনার বাড়ির মডেম বা ONU (Optical Network Unit) পর্যন্ত এসে পৌঁছায়। এরপর শুরু হয় আপনার নিজস্ব লোকাল নেটওয়ার্কের কাজ, যার প্রধান চালিকাশক্তি হলো আপনার Wi-Fi রাউটার। এই রাউটারই আপনার বিভিন্ন ডিভাইসে (যেমন - ফোন, ল্যাপটপ, স্মার্ট টিভি) ইন্টারনেট প্রদান করে।

সহজভাবে বললে, ISP হলো আপনার বাড়িতে আসা বিদ্যুতের মূল লাইনের মতো, আর আপনার বাড়ির ভেতরের ওয়্যারিং, সুইচবোর্ড এবং লাইট-ফ্যান হলো আপনার লোকাল নেটওয়ার্ক (রাউটার ও কানেক্টেড ডিভাইস)। যদি বিদ্যুতের মূল লাইনে সমস্যা হয়, তার দায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার। কিন্তু আপনার বাড়ির ভেতরের ওয়্যারিং বা কোনো অ্যাপ্লায়েন্সে সমস্যা হলে সেটা আপনাকেই সমাধান করতে হয়। Wi-Fi এর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা একই রকম।

সাধারণ কিছু লোকাল Wi-Fi সমস্যা যেখানে ISP-এর ভূমিকা কম

এমন অনেক পরিস্থিতি রয়েছে যেখানে Wi-Fi সমস্যার মূল কারণ আপনার লোকাল নেটওয়ার্কের মধ্যেই নিহিত থাকে।

১. রাউটারের সমস্যা (এমনকি নতুন রাউটারেও): সম্প্রতি আমরা একটি ফেসবুক পোস্টে দেখেছি যেখানে একজন ব্যবহারকারী  তার একদম নতুন Mercusys AC12G রাউটারেও মারাত্মক ল্যাটেন্সি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। তিনি একটি নেটওয়ার্ক অ্যানালাইজার অ্যাপের মাধ্যমে লোকাল আইপি (192.168.1.1) পিং করে দেখিয়েছেন যে সেখানে পিং কখনো কখনো ১০০০ মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত চলে যাচ্ছে, যেখানে স্বাভাবিক পিং খুবই কম (যেমন ১-১০ মিলিসেকেন্ড) থাকা উচিত।

এরকম সমস্যার কারণ হতে পারে:
* **ত্রুটিপূর্ণ হার্ডওয়্যার:** নতুন হলেও রাউটারের হার্ডওয়্যারে সমস্যা থাকতে পারে। ফেসবুকের ওই আলোচনাতেই আরেকজন ব্যবহারকারী তার অভিজ্ঞতায় বলেছেন যে দামি নতুন রাউটারেও হার্ডওয়্যারগত সমস্যা থাকতে পারে এবং রিপ্লেসমেন্টের পর তার সমস্যার সমাধান হয়েছিল।
* **ফার্মওয়্যার বাগ বা পুরনো ফার্মওয়্যার:** রাউটারের অপারেটিং সিস্টেমে (ফার্মওয়্যার) কোনো বাগ থাকলে অথবা ফার্মওয়্যার আপডেট না করা হলে পারফরম্যান্সে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
* **ভুল কনফিগারেশন:** অনেক সময় ভুল কনফিগারেশনের কারণেও নেটওয়ার্ক অস্থিতিশীল হতে পারে।
* **অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া:** রাউটার ঠিকমতো বাতাস চলাচলের সুযোগ না পেলে বা অতিরিক্ত গরম হয়ে গেলে তার কার্যক্ষমতা কমে যায়।

২. রাউটারের দুর্বল অবস্থান ও প্রতিবন্ধকতা: আপনার রাউটারটি বাড়ির কোন জায়গায় রেখেছেন তার উপর Wi-Fi সিগন্যালের শক্তি ও পরিধি অনেকটাই নির্ভর করে। দেয়াল, ধাতব বস্তু, আসবাবপত্র ইত্যাদি সিগন্যালের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। রাউটার বাড়ির মাঝামাঝি কোনো খোলা জায়গায় এবং কিছুটা উঁচুতে রাখলে ভালো কভারেজ পাওয়া যায়।

 

 

৩. পারিপার্শ্বিক ইন্টারফারেন্স: আপনার বাড়ির অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস যেমন – মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লুটুথ ডিভাইস, কর্ডলেস ফোন এমনকি প্রতিবেশীর Wi-Fi নেটওয়ার্কও আপনার Wi-Fi সিগন্যালে বাধা বা ইন্টারফারেন্স তৈরি করতে পারে। এর ফলে স্পিড কম ও সংযোগ অস্থিতিশীল হতে পারে। Wi-Fi রাউটারের জায়গা পরিবর্তন করে অনেক সময় এই সমস্যার সমাধান করা যায়।

৪. কানেক্টেড ডিভাইসের সমস্যা: অনেক সময় সমস্যা রাউটারের নয়, বরং আপনার ব্যবহৃত ডিভাইসেরও হতে পারে। যেমন: * ডিভাইসের Wi-Fi অ্যাডাপ্টারের পুরনো ড্রাইভার। * ডিভাইসের অপারেটিং সিস্টেমের সমস্যা। * ডিভাইসের Wi-Fi রিসিভিং ক্ষমতা দুর্বল হওয়া।

৫. অতিরিক্ত ডিভাইসের চাপ: কিছু রাউটার নির্দিষ্ট সংখ্যক ডিভাইস পর্যন্ত ভালোভাবে সার্ভিস দিতে পারে। যদি একই সময়ে অনেক বেশি ডিভাইস কানেক্ট করা হয়, তাহলে রাউটারের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং পারফরম্যান্স খারাপ হতে পারে।

কীভাবে বুঝবেন সমস্যাটি আপনার লোকাল নেটওয়ার্কের?

  • লোকাল পিং টেস্ট: আপনার ফোন বা কম্পিউটার থেকে রাউটারের গেটওয়ে আইপি (সাধারণত 192.168.1.1 বা 192.168.0.1) পিং করুন। যদি এখানে পিং টাইম অনেক বেশি বা টাইম-আউট দেখায় , তাহলে সমস্যাটি আপনার লোকাল নেটওয়ার্ক বা রাউটারের।
  • ইথারনেট কেবলে পরীক্ষা: রাউটার থেকে সরাসরি ইথারনেট (LAN) কেবলের মাধ্যমে আপনার ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে দেখুন। যদি কেবলে স্পিড ঠিক থাকে কিন্তু Wi-Fi তে সমস্যা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সমস্যাটি Wi-Fi সম্পর্কিত। ফেসবুকের আলোচিত পোস্টেও  উল্লেখ করেছিলেন যে তার ইথারনেট সংযোগে পিং ১ মিলিসেকেন্ড আসছিল, কিন্তু ওয়্যারলেসে সমস্যা হচ্ছিল।

কেন এক্ষেত্রে ISP সরাসরি সাহায্য করতে পারে না?

আইএসপি তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আপনার বাড়ি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ। তাদের কাছে থাকা ডায়াগনস্টিক টুল  দিয়ে তারা তাদের প্রান্ত থেকে আপনার মডেম/ONU পর্যন্ত সংযোগ পরীক্ষা করতে পারে। কিন্তু আপনার বাড়ির ভেতরের Wi-Fi নেটওয়ার্ক, রাউটারের সেটিংস, আপনার ডিভাইসের কনফিগারেশন – এগুলোর উপর তাদের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাই, সমস্যা যদি আপনার লোকাল নেটওয়ার্কেই হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আইএসপি-র পক্ষে সরাসরি কিছু করা কঠিন।

আপনি নিজে যা করতে পারেন (Troubleshooting):

১. রাউটার রিস্টার্ট করুন: এটি সবচেয়ে সাধারণ এবং অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর একটি পদক্ষেপ।

২. রাউটারের ফার্মওয়্যার আপডেট করুন: প্রস্তুতকারকের ওয়েবসাইট থেকে আপনার রাউটারের সর্বশেষ ফার্মওয়্যার ডাউনলোড করে আপডেট করুন।

৩. রাউটারের অবস্থান পরিবর্তন করুন: সম্ভব  হলে রাউটারটিকে বাড়ির মাঝামাঝি কোনো খোলা জায়গায় রাখুন।

৪. Wi-Fi চ্যানেল পরিবর্তন করুন: রাউটারের সেটিংস থেকে একটি কম ব্যবহৃত Wi-Fi চ্যানেল নির্বাচন করুন।

৫. ডিভাইসের ড্রাইভার আপডেট করুন: আপনার কম্পিউটার বা ল্যাপটপের Wi-Fi ড্রাইভার আপডেট করুন।

৬. কম ডিভাইস কানেক্ট করে দেখুন: কয়েকটি ডিভাইস ডিসকানেক্ট করে দেখুন পারফরম্যান্স ভালো হয় কিনা।

 ৭. রাউটার রিসেট করুন: যদি কোনো কিছুতেই কাজ না হয়, তাহলে রাউটার ফ্যাক্টরি রিসেট করে দেখতে পারেন (তবে এরপর রাউটার আবার  কনফিগার করতে হবে)।

৮. সম্ভব হলে রাউটার পরিবর্তন করুন: যদি উপরের কোনো পদক্ষেপে সমস্যার সমাধান না হয় এবং আপনি নিশ্চিত হন যে সমস্যাটি রাউটারের, বিশেষ করে যদি সেটি পুরনো হয়ে থাকে বা নতুন হওয়া সত্ত্বেও ত্রুটিপূর্ণ বলে সন্দেহ হয় , তাহলে একটি ভালো মানের নতুন রাউটার কেনার কথা ভাবতে পারেন বা ওয়ারেন্টি থাকলে বিক্রেতার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

 

কখন ISP-এর সাথে যোগাযোগ করবেন?

  • আপনার ISP মূলত WAN পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে। LAN পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও Wi-Fi সেটিংস সম্পূর্ণ আপনার নিজস্ব।
  • Ethernet দিয়ে সরাসরি latency ঠিক থাকলে, Wi-Fi latency সমস্যার সমাধান আপনার রাউটার বা সেটিংসে করতে হবে।
  • যদি ইথারনেট কেবলের মাধ্যমে সরাসরি সংযোগেও ইন্টারনেটের গতি কম পান বা সংযোগ অস্থিতিশীল থাকে।
  • যদি আপনার মডেম বা ONU-তে ইন্টারনেট বা WAN সম্পর্কিত কোনো সতর্কতামূলক ইন্ডিকেটর লাইট জ্বলে থাকে।
  • যদি আপনি সন্দেহ করেন যে আইএসপি-র প্রধান লাইনে বা পোর্টে সমস্যা হয়েছে।

শেষ কথা

Wi-Fi latency সমস্যা অবশ্যই বিরক্তিকর, তবে সঠিক কারণ বের করে সেটিংস ঠিক করলে এটি সহজেই সমাধান করা যায়। ISP এবং ব্যবহারকারী উভয়ের মধ্যেই দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে এই বিভ্রান্তি কমে আসবে।


আপনার সুবিধার জন্য Wi-Fi latency সংক্রান্ত আরও বিস্তারিত জানতে বা পরামর্শ নিতে যোগাযোগ করুন: SaltSync Internet